সম্ভাবনার যাত্রা এবার পদ্মার ওপারে

 ঢাকা দেশের সবচেয়ে বড় বাজার। এই বাজারের সঙ্গে দক্ষিণ ও দক্ষিণ–পশ্চিমাঞ্চলের ১৯টি জেলা সরাসরি যুক্ত করবে পদ্মা সেতু।


এত দিন যেটা ছিল স্বপ্ন, সেটা এখন বাস্তবতা নিউজ: প্রথম আলো



ঢাকা থেকে উত্তরের জেলা বগুড়ার দূরত্ব ১৯১ কিলোমিটার। জেলাটির পাইকারি বাজার মহাস্থানহাটে সকালে যে সবজি কেনাবেচা হয়, তা রাতেই চলে আসে ঢাকার কারওয়ান বাজারে। রাজধানীবাসী সকালে বাজারে গিয়ে কেনেন বগুড়ার কৃষকের খেতে উৎপাদিত ঢ্যাঁড়স, ঝিঙে।

১৯৯৮ সালে যমুনা নদীর ওপর বঙ্গবন্ধু বহুমুখী সেতু চালু হওয়ার আগে বগুড়া থেকে তেমন কোনো সবজি ঢাকায় আসত না বলে জানান সেখানকার ব্যবসায়ীরা। চারদশক ধরে আড়তদারির সঙ্গে যুক্ত মহাস্থান হাটের আড়তদার সমিতির সাধারণ সম্পাদক শফিকুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলছিলেন, বঙ্গবন্ধু সেতু চালুর আগে মহাস্থান ছিল মূলত গরু-ছাগল আর ধানের হাট। এ হাটে সবজি তেমন বেচাবিক্রি হতো না। এখন এটা সবজি কেনাবেচার বড় কেন্দ্র হয়ে উঠেছে।

চিত্রটা বিপরীত দক্ষিণের জেলা বরিশালে। ঢাকার সঙ্গে মাওয়া হয়ে বরিশালের দূরত্ব ১৬০ কিলোমিটারের মতো। কিন্তু সেখান থেকে কোনো কৃষিপণ্য নিয়ে রওনা দিলে পদ্মা পাড়ি দিতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হতো। নদীটি পাড়ি দিতে কত সময় লাগবে, তার কোনো নিশ্চয়তা ছিল না। স্রোত বেশি হলে ফেরি বন্ধ থাকত, কুয়াশায় ফেরি বন্ধ থাকত, নদীর নাব্যতা–সংকটে ফেরি চলাচলে বিঘ্ন ঘটত।


এত অনিশ্চয়তা নিয়ে ব্যবসায়ীরা পদ্মার ওপারে শিল্প গড়ে তুলতে সাহস দেখাননি। ওই অঞ্চলে ঢাকাকে কেন্দ্র করে তেমন কোনো পণ্যবাণিজ্য গড়ে ওঠেনি। অবশ্য এবার বাধা কাটছে, পদ্মা নদীর ওপর ৩০ হাজার ১৯৩ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত পদ্মা সেতু আজ শনিবার উদ্বোধন করা হচ্ছে। এত দিন যেটা ছিল স্বপ্ন, সেটা এখন বাস্তবতা।


বড় বাজারের সংযোগ

ঢাকা বাংলাদেশের বড় বাজার। ঢাকা মহানগরে জনসংখ্যা প্রায় দুই কোটি। দেশে যে সাড়ে চার কোটির মতো মধ্যবিত্ত আছেন, তার বড় অংশ রাজধানীতে বাস করেন। অর্থনীতিবিদেরা বলছেন, রাজধানীর এই বাজারের সঙ্গে যেসব উৎপাদনকেন্দ্রের সরাসরি সংযোগ রয়েছে, সেখানেই উৎপাদন বেড়েছে, মানুষের আয় বেড়েছে।

যেমন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক আবুল বায়েস ২০০৭ সালে জাপান ব্যাংক ফর ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশনের (জেবিআইসি) জন্য বঙ্গবন্ধু সেতুর অর্থনৈতিক প্রভাব নিয়ে একটি সমীক্ষা করেন। এতে সেতু হওয়ার আগে ও পরে সাতটি গ্রামের মানুষের ওপর জরিপ করা হয়। দেখা যায়, যে পাঁচটি গ্রাম সেতুর সুফল পেয়েছে, তাদের ফসলের দাম বাড়ার হার, আয় বৃদ্ধি ও দারিদ্র্য কমার হার বেশি। অন্যদিকে দুটি গ্রাম সেতুর সরাসরি সুফল পায়নি। সেখানে ফসলের দাম বাড়ার হার, আয় বৃদ্ধি ও দারিদ্র্য কমার হার ততটা বেশি নয়। সরাসরি সেতুর সুফল পাওয়া গ্রামে সেতু চালুর পর ছয় বছরে চালের দাম বছরে ৬ শতাংশ হারে বাড়ে। বিপরীতে সুফল না পাওয়া গ্রামে বাড়ে ৩ শতাংশ হারে। সব ফসলের দামের ক্ষেত্রেই এ চিত্র দেখা যায়।

পদ্মা সেতুর জন্য জাপানের উন্নয়ন সহযোগী সংস্থা জাইকা যে সম্ভাব্যতা সমীক্ষা করেছিল, সেখানে উঠে আসে যে পদ্মা সেতুর কারণে দেশের সার্বিক জিডিপি (মোট দেশজ উৎপাদন) বাড়বে ১ দশমিক ২৩ শতাংশ। আর দক্ষিণ ও দক্ষিণ–পশ্চিমাঞ্চলের জেলাগুলোর জিডিপি বাড়বে ২ দশমিক ৩ শতাংশ।


জিডিপি হলো দেশের অভ্যন্তরে যে পণ্য ও সেবা উৎপাদিত হয়, তার সম্মিলিত মূল্য। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) প্রাথমিক হিসাবে, ২০২১–২২ অর্থবছরে বাংলাদেশের জিডিপির আকার দাঁড়িয়েছে চলতি বাজারমূল্যে ৩৯ লাখ ৭৬ হাজার কোটি টাকা। জিডিপি বৃদ্ধি মানে বাড়তি উৎপাদন ও বাড়তি কর্মসংস্থান।

জিডিপি বাড়বে কীভাবে, তা একটি উদাহরণ দিয়ে বুঝিয়ে দেওয়া যাক। সেতুর ওপর দিয়ে যত বেশি যানবাহন চলবে, সেবা খাতে তত বেশি মূল্য যোগ হবে। যে ব্যক্তি বছরে দুবার গ্রামের বাড়ি যেতেন, তিনি এখন আরও বেশিবার যাওয়ার সুযোগ পাবেন। কারণ, ফেরিঘাটের ভোগান্তি থাকবে না। বাড়তি যাত্রীর আশায় দক্ষিণ ও দক্ষিণ–পশ্চিমাঞ্চলের পরিবহন ব্যবসায়ীরা নতুন নতুন বাস কিনছেন। বাস কিনতে ঋণ দিয়ে ব্যাংকের ব্যবসা বাড়ছে, বাস কোম্পানির বিক্রি বাড়ছে। বাস কেনার টাকা হাতবদল হয়ে পণ্য ও সেবার বিক্রি বাড়াচ্ছে। তাতে জিডিপি বাড়ছে। নতুন বাস নতুন কর্মী নিয়োগ দেবে, যা মানুষের কর্মসংস্থান বাড়াবে।

পদ্মা সেতুর ওপর দিয়ে প্রতিবছর কী পরিমাণে যানবাহন চলাচল করবে, তা নিয়ে ২০০৫ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত কয়েকটি সমীক্ষা হয়। সমীক্ষাগুলো করে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) ও জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সি (জাইকা) এবং সেতু বিভাগের জন্য সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিং (সানেম)।

এডিবি তখন বলেছিল, ২০২২ সালে পদ্মা সেতু দিয়ে প্রতিদিন চলাচল করবে প্রায় ২৪ হাজার যানবাহন। সংখ্যাটি প্রতিবছরই বাড়বে।


এবার দক্ষিণের সুযোগ

বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৫১ বছর ধরে দক্ষিণ ও দক্ষিণ–পশ্চিমাঞ্চলের ১৯ জেলা সরাসরি সড়ক যোগাযোগ থেকে বিচ্ছিন্ন ছিল। দেখা যাচ্ছে, ওই সব জেলায় অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড তেমন একটা বিকশিত হয়নি।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর ২০১৩ সালের অর্থনৈতিক শুমারি অনুযায়ী, অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে উত্তরের বিভাগ রাজশাহী ও রংপুরের চেয়ে পিছিয়ে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমের খুলনা ও বরিশাল। যেমন রংপুরে অর্থনৈতিক স্থাপনার সংখ্যা ছিল ১০ লাখের বেশি। বরিশালে তা ছিল সাড়ে ৩ লাখের মতো। একসময়ের শিল্পসমৃদ্ধ খুলনাও রংপুরের চেয়ে পিছিয়ে।

দক্ষিণ ও দক্ষিণ–পশ্চিমাঞ্চলের জেলাগুলোর ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলেছেন প্রথম আলোর প্রতিবেদক ও প্রতিনিধিরা। ব্যবসায়ীরা বলছেন, সেতুটি তাঁদের জেলায় সম্ভাবনার দুয়ার খুলবে।

খুলনা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সহসভাপতি সিদ্দিকুর রহমান বিশ্বাস বলেন, ভাঙ্গা উপজেলার তিন দিকে তিনটি রাস্তা চলে গেছে—একটি বরিশাল, একটি খুলনা এবং আরেকটি রাজবাড়ী, যশোর ও বেনাপোলের দিকে। তিনটি সড়ক যুক্ত হবে মোংলা ও পায়রা সমুদ্রবন্দর এবং বেনাপোল স্থলবন্দরের সঙ্গে। ফলে তিনটি বন্দর দিয়ে আমদানিপণ্য দ্রুত ঢাকাসহ শিল্পাঞ্চলগুলোয় ঢুকতে পারবে। এতে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে যুক্ত হবে বহুমুখী খাত।


Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url